x

করোনায় কুরবানি : আপনার করণীয় কী?

প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে ঘনিয়ে আসছে কুরবানি। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী আগামী ৩১ জুলাই বা ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে এ করবানি। এবারের কুরবানির রূপরেখা কেমন হবে? মহামারির এ সময়ে মানুষের কুরবানির ভাবনা কেমন হওয়া উচিত।

এ নিয়ে ইতিমধ্যে চলছে অনেক জল্পনা-কল্পনা। চলছে আলোচনা-টকশো। করোনায় কুরবানি করায় মানুষের করণীয় কী? এ সম্পর্কেও রয়েছে মানুষের অনেক জিজ্ঞাসা।

কুরবানীর‌ ‌ধারণাঃ‌ ‌ ‌

কুরবানীর সমার্থক শব্দ ‘উদ্‌হিয়্যাহ’। এর আভিধানিক অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যে পশু জবাই করা হয়, তাকে কুরবানী বলে।
বর্তমানে যে কুরবানী প্রথা প্রচলিত আছে, তা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সময় থেকে চলে আসছে। এটি আত্মত্যাগ ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অন্যতম মাধ্যম। এটি একটি উত্তম ইবাদত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কুরবানীর দিনে রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কাজ আল্লাহর নিকট আর কিছুই নেই। কুরবানী দাতা কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু শিং, ক্ষুর ও লোমসমূহ নিয়ে হাজির হবে। কুরবানীর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর দরবারে বিশেষ মর্যাদার স্থানে পৌঁছে যাবে। অত:এব তোমরা কুরবানীর দ্বারা নিজেদেরকে পবিত্র কর।” (তিরমিযি শরীফ)
রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।” (ইবনু মাজাহ শরীফ)

কুরবানীর ঐতিহাসিক পটভূমিঃ

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা বহুবার বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেছেন। সকল পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। এবার তিনি এক অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। একরাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানী করতে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আদেশ করছেন। বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান ইসমাঈল অপেক্ষা অধিকতর প্রিয় আর কি হতে পারে? অনেক চিন্তাভাবনা করে তিনি শেষ সিন্ধান্তে পৌঁছলেন, আল্লাহ তায়ালা যাতে খুশি হন তাই তিনি করবেন। পবিত্র কুরআনের সূরা আস সফ্ফাত এর ১০২নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“অত:পর যখন তিনি (হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম) তাঁর (হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম) এর সাথে কাজ করার উপযুক্ত হলেন, তখন (হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম) বললেন, হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি। এখন তুমি দেখ তোমার অভিমত কী? (হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম) বললেন, হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। আল্লাহ চাহেতো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।”
ছেলের এ সাহসিকতাপূর্ণ উত্তর পেয়ে নবী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম খুব খুশি হলেন। আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর গলায় ছুরি চালালেন। এবারের পরীক্ষাতেও হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উত্তীর্ণ হলেন। পবিত্র কুরআনের সূরা আস সফ্ফাত এর ১০৪ ও ১০৫নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“তখন আমি তাকে আহবান করে বললামঃ হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করলে।”
আল্লাহ তায়ালা খুশি হয়ে জান্নাত থেকে একটি দুম্বা এনে ইসমাঈল-এর জায়গায় ছুরির নীচে শুইয়ে দিলেন। হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর পরিবর্তে দুম্বা কুরবানী হয়ে গেল। এ অপূর্ব ত্যাগের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য তখন হতে কুরবানী প্রথা চালু হয়েছে। এটি আজ মুসলিম সমাজে একটি পবিত্র ধর্মানুষ্ঠানরূপে স্বীকৃত।

কুরবানীর নিয়মাবলি ও বিধিবিধানঃ

কুরবানী দাতার করণীয়ঃ

যে কুরবানী করতে চায়, সে যিলহজ্জের দশ তারিখ পর্যন্ত তার চুল কাটবে নাঃ উম্মে সালামাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানী দেওয়ার ইচ্ছা রাখে, তারা যেন যিলহাজ্জ মাসের চাঁদ ওঠার পর হতে কুরবানী সম্পন্ন করা পর্যন্ত স্ব স্ব চুল ও নখ কর্তন করা হতে বিরত থাকে”। [মুসলিম, মিশকাত হাঃ১৪৫৯; নাসাঈ, মির‘আত হাঃ১৪৭৪-এর ব্যাখ্যা, ৫/৮৬ পৃঃ]

যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিবঃ

প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

নিসাব হলঃ স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। (আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)

কুরবানীর সময়ঃ

যিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত মোট তিন দিন কুরবানীর সময়। তবে সবচেয়ে উত্তম হল প্রথম দিন কুরবানী করা। এরপর দ্বিতীয় দিন এরপর তৃতীয় দিন। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫)

ঈদুল আযহার নামাযের আগে কুরবানী করা জায়েজ নেই। নামায আদায়ের পর কুরবানী করতে হবে। 

হযরত বারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ঈদের দিন আমরা প্রথমে নামায আদায় করি। অত:পর ফিরে এসে কুরবানী করি। যে ব্যক্তি এভাবে আদায় করবে সে আমাদের নিয়ম মতো করল। আর যে নামাযের আগেই পশু জবাই করল সেটা তার পরিবারের জন্য গোশত হবে, এটা কুরবানী হবে না। (সহীহ মুসলিম ২/১৫৪)

কুরবানীর পশুঃ

উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। তদ্রূপ হাঁস-মুরগি বা কোনো পাখি দ্বারাও কুরবানী জায়েয নয়। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-“ আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর নির্দেশ দিয়েছি। আল্লাহ তাদের রুযি হিসেবে যেসব গৃহপালিত পশু দিয়েছেন তার উপর তারা যেন (জবাই করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে”। (সূরা হজ্ব : ৩৪)

যেসব পশু কুরবানী করা জায়েয সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানী করা যায়। (কাযীখান ৩/৩৪৮,  বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)

কুরবানীর পশুর বয়সঃ

উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে। 

উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না। (কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬)

হযরত জাবের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা (কুরবানীর জন্য) মুসিন্নাহ ব্যতীত যবাই করো না”। (মুসিন্নাহ হল, ৫ বছর বয়সী উট, ২ বছরের গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে ১ বছর [শরহুন নববী]) যদি সম্ভব না হয় তবে ছয় মাস বয়সী ভেড়া বা দুম্বা। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৯৬৩)

কুরবানীর পশুতে শরীকের সংখ্যাঃ

একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে কুরবানী করলে কারোটাই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৯, কাযীখান ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮)

হযরত জাবের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ করেছেন যে, আমরা একটি গরু এবং একটি উটে সাতজন করে শরীক হয়ে যাই। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১২১৮)

সাতজনে মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানী সহীহ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)

উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)

কুরবানীর গোশত বণ্টনঃ

শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়। (আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১)

কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরীব-মিসকীনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত নিজে রেখে দেওয়াও নাজায়েয নয়। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪, আলমগীরী ৫/৩০০)

কুরবানির পশু জবাইয়ের নিয়ম ও দোয়াঃ

নিজ হাতে কুরবানী করা উত্তম। ইসলামী শরীয়তে পশু জবাই করার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে। (১) জবাইকারী ব্যক্তি মুসলমান হতে হবে। (২) জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে হবে।  (৩) পশুর খাদ্যনালী, শ্বাসনালী ও গলায় অবস্থিত অন্যান্য রগ ভালভাবে কাটতে হবে। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, ২য় খন্ড, ৩৭৫ পৃষ্ঠা।)

কুরবানীর পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে এবং পা পশ্চিম দিকে রেখে অর্থাৎ ক্বিবলামুখী করে শোয়ায়ে পূর্ব দিক থেকে চেপে ধরতে হবে, তারপর কুরবানীর করতে হবে। আর  কুরবানী করার সময় খেয়াল রাখতে হবে যে, সীনার উপরিভাগ এবং কণ্ঠনালীর মাঝামাঝি স্থানে যেন যবেহ করা হয়। আরো উল্লেখ্য যে, গলাতে চারটি রগ রয়েছে, তন্মধ্যে গলার সম্মুখভাগে দুটি- খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী এবং দু’পার্শ্বে দুটি রক্তনালী। এ চারটির মধ্যে খাদ্যনালী, শ্বাসনালী এবং দুটি রক্তনালীর মধ্যে একটি অবশ্যই কাটতে হবে। অর্থাৎ চারটি রগ বা নালীর মধ্যে তিনটি অবশ্যই কাটতে হবে, অন্যথায় কুরবানী হবেনা। যদি সম্ভব হয়, তবে ছুরি চালানোর সময় বিজোড় সংখ্যার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

কুরবানীর নিয়ত: (যবেহ করার পূর্বে)

“ইন্নী ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না ছলাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহ্ইয়া ইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। লা শারীকালাহু ওয়া বি যালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন। আল্লাহুম্মা মিনকা ও লাকা”। এ দোয়া পড়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে যবেহ করতে হবে।

যবেহ করার পর এ দোয়া পড়বে-

“ আল্লাহুম্মা তাক্বাব্বালহু মিন্নী কামা তাক্বাব্বালতা মিন হাবীবিকা সাইয়্যিদিনা রাসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খালীলিকা ইব্রাহীমা আলাইহিস সালাম”।

যদি নিজের কুরবানী হয়, তবে منى (মিন্নী) বলতে হবে। আর যদি  অন্যের  কুরবানী হয়, তবে  من (মিন) শব্দের পর যার বা যাদের কুরবানী, তার বা তাদের নাম উল্লেখ করতে হবে। আর যদি অন্যের সাথে শরীক হয়, তাহলে منى (মিন্নী)ও বলবে, অতঃপর من (মিন) বলে অন্যদের নাম বলতে হবে। কেউ যদি উপরোক্ত নিয়ত না জানে, তাহলে জবেহ করার সময় শুধু বিস্মিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে কুরবানী করলেও শুদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ নিয়ত অন্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবে অবশ্যই প্রত্যেক যবেহকারীর উচিত উপরোক্ত নিয়ত শিক্ষা করা। কেননা উপরোক্ত নিয়ত পাঠ করে কুরবানী করা সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। ( আহমদ, আবূ দাউদ, তিরমীযী, দারিমী ইবনে মাযাহ, বজলূল মযহুদ, মিশকাত, মিরকাত, মুযাহেরে হক্ব, লুমায়াত, ত্বীবী, তালিকুছ ছবীহ, আশয়াতুল লুমায়াত, আলমগীরী, শামী, দুররুল মুখতার, আইনুল হিদায়া)

প্রত্যেক মুসলমানদের উচিৎ কুরবানীর সময় একাগ্রতার সাথে উত্তম পশু কুরবানী করা। তাতে তাঁরা অনেক ছাওয়াব পাবে। পরস্পরের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়বে এবং হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

কুরবানীর ত্যাগের শিক্ষাঃ

কুরবানী বলতে শুধু গরু, ছাগল, মহিষ, দুম্বা ইত্যাদি জবাই করাই বোঝায় না। বরং এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন বোঝায়। কুরবানী আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর অতুলনীয় ত্যাগের স্মৃতি বহন করে। এর মাধ্যমে মুসলমানগণ ঘোষণা করেন যে, তাদের কাছে নিজ জানমাল অপেক্ষা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মূল্য অনেক বেশি। তারা পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে এর রক্ত প্রবাহিত করে আল্লাহর কাছে শপথ করে বলে, “হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যেভাবে পশুর রক্ত প্রবাহিত করছি, প্রয়োজনে আমাদের শরীরের রক্ত প্রবাহিত করতেও কুন্ঠিত হব না।” কে কত টাকা খরচ করে পশু ক্রয় করেছে, কার পশু কত মোটাতাজা, কত সুন্দর আল্লাহ তায়ালা তা দেখতে চান না। তিনি দেখতে চান কার অন্তরে কতটুকু আল্লাহর ভালোবাসা ও তাকওয়া আছে। পবিত্র কুরআনের সূরা আল হাজ্ব এর ৩৭নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

 “কখনো আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এগুলোর গোশত এবং রক্ত বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।”

আত্মত্যাগ ও আত্মসমার্পনের মূর্তপ্রতীক ছিলেন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। মানুষের জীবনে এ শিক্ষা গ্রহন করলে তারা হয়ে উঠবে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল, পরোপকারী ও আত্মত্যাগী। আত্মত্যাগী মানুষই সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। নিজের সুখ-শান্তির বাইরে যারা সমাজের মানুষের সুখকে বড় করে দেখে, তারাই প্রকৃত মানুষ। কুরবানীর ত্যাগের শিক্ষা আমাদেরকে পরোপকারে উৎসাহিত করবে ও মানবতাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটাবে।

করোনায় কুরবানি
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে ঘনিয়ে আসছে কুরবানি। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী আগামী ৩১ জুলাই বা ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে এ করবানি। এবারের কুরবানির রূপরেখা কেমন হবে? কিংবা মহামারির এ সময়ে মানুষের কুরবানির ভাবনা কেমন হওয়া উচিত। এ নিয়ে ইতিমধ্যে চলছে অনেক জল্পনা-কল্পনা। চলছে আলোচনা-টকশো। রয়েছে অনেক মানুষের জিজ্ঞাসা।

কুরবানি সম্পর্কে মানুষের জিজ্ঞাসাগুলো হলো-

– এবার করোনায় কুরবানি না করে এ টাকা গরিব-অসহায়দের মাঝে দান করায় কুরবানির হক আদায় হবে কি?

– অনেকেই প্রতি বছর স্বাভাবিকভাবেই কুরবানি করতেন, এবার অর্থ সংকটের কারণে কুরবানি করা সম্ভব হচ্ছে না, তাদের জন্য করণীয় কী হতে পারে?

– দেশের বাইরে প্রবাসে এমন অনেক লোক আছেন যারা এবার পরিস্থিতির কারণে কুরবানি করতে পারছেন না, তারা এ দায় থেকে কীভাবে বেঁচে থাকবেন?

যারা কুরবানি দিতে পারেন তাদের যেমন সম্পৃক্ততা রয়েছে তেমনি যারা কুরবানি দিতে পারে না এমন সব অভাবি মানুষের সম্পর্কও রয়েছে এ কুরবানির সঙ্গে। তারা সারা বছর গরু/খাশির গোস্ত কিনে খেতে পারেন না। কুরবানির সময়ই তারা চাহিদা মিটিয়ে গোশ্ত খেতে পারেন। আর এতে ধনী-গরিবের মিলন হয় বৈষম্য দূর হয়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও আন্তরিকতা তৈরি হয়।

এমন অনেক ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা যারা কোটি কোটি টাকা কুরবানি উপলক্ষ্যে পশুতে বিনিয়োগ করেছেন। তাদের বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। কেননা কুরবানির একটি মৌসুমের ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা বছরব্যাপী জীবিকা অর্জন করে থাকে।

সুতরাং কুরবানি হচ্ছে- ইবাদত, গরিব-দুঃখীর অধিকার, ব্যবসায়ীর জীবন-জীবিকায় বিনিয়োগ। তাই এসব বিবেচনায় কুরবানি বন্ধ নয়, কুরবানির পশুর হাটও বন্ধ নয় বরং যথাযথ স্বাস্থ্য নিরাপত্তার মাধ্যমে এটি অব্যাহত রাখাই জরুরি।

কুরবানি না করে দান করা  প্রসঙ্গ
যদি কেউ কুরবানি না করে সে অর্থ (টাকা-পয়সা) দান করে দেয় তাতে পশু কুরবানির দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পাওয়া যাবে কি না। আর তাতে আমাদের করণীয় কী?
ইসলামি শরিয়া ও স্কলারদের মতে, এ বিষয়টিতে সুস্পষ্ট ও সরল উত্তর হলো- কুরবানি না করে এ টাকা দান করে দেয়া হলে কুরবানির আমল বা ইবাদত থেকে দায়মুক্তি হবে না। তাতে কুরবানির হক আদায় হবে না।

অন্য একটি জিজ্ঞাসা
বিগত বছর কুরবানি দেয়া ব্যক্তি অর্থকষ্টের কারণে এবার কুরবানি দিতে পারছে না, এতে তার করণীয় কী?
তাদের জন্য সহজ উত্তর : অন্য বছরগুলোতে কুরবানি দিয়েছেন। কিন্তু এবার অর্থকষ্ট বা অভাবের কারণে কুরবানি দিতে পারছে না, তারা এ বছর কুরবানি দেবেন না। ইসলামি শরিয়াহ কারো সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো আমল বা চাপিয়ে দেয় না। ওই আমল করতে বাধ্য করে না।

কুরবানিকে সামাজিক ইস্যু মনে করা
এমন অনেক লোক আছেন যারা স্বাভাবিকভাবে কুরবানি দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। কিন্ত সামাজিক লোক-লজ্জার ভয়ে চরম চাপ নিয়ে কুরবানি করে থাকেন। আসলে সামাজিক লোক-লজ্জার ভয় বা ইজ্জত-সম্মানের কারণে কুরবানি দিতে হয়, এমনটি সঠিক নয়, বরং এটি মানুষের ভুল ধারণা। সুতরাং অর্থকষ্ট থাকলে এবং সামর্থ্য না থাকলে কুরবানি না করায় কোনো সমস্যা নেই।

এদের জন্য সুসংবাদ
তবে যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকাকালীন সময় কুরবানি পালন করে ইবাদত করেছেন, এখন সামর্থ্য না থাকার কারণে যদি কুরবানি করতে না পারেন, তাতেও আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তিকে কুরবানির সাওয়াব দিয়ে দেবেন। এটি নিয়ে সাময়িক সামর্থ্যহীন ব্যক্তিদের মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই।

প্রবাসে অবস্থানকারীদের কুরবানি
বিদেশে এমন অনেক মুমিন মুসলমান রয়েছেন, যারা এমন জায়গায় আছেন যেখানে হয়তো কোনো বিধি-নিষেধ, আইনি জটিলতা বা করোনার সংক্রান্ত কোনো কারণে কুরবানি দিতে পারছেন না। তাদের করণীয় কী? তাদের করণীয় হলো-
যেখানে অবস্থান করছেন, যদি সেখানে কুরবানি করতে না পারেন তবে নিজ নিজ দেশে কিংবা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে কুরবানি করার সুযোগ রয়েছে তাদের মাধ্যমে দায়িত্ব দিয়ে কুরবানি আদায় করা। এভাবে তারা কুরবানির ইবাদত ও আমল থেকে মুক্ত হতে পারবেন।

আবার যারা দেশে অবস্থান করছেন কিন্ত নিজে নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজে কুরবানির ব্যবস্থা করতে পারছেন না, তিনিও অন্য কারো মাধ্যমে দেশের অন্য কোথাও দায়িত্ব দিয়েও কুরবানির ব্যবস্থা করতে পারবেন। তারপরও কুরবানির এ গুরুত্বপূর্ণ আমল ও ইবাদতটি যথাযথ মর্যাদায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা লাভে করতে হবে।

হালাল বাজারের মাধ্যমে গরীব এতিমদের সাথে হোক এবারের কুরবানি!   
বাংলাদেশিদের সকলের সুবিধার্থে হালাল বাজার  টিম এ বছর কুরবানির সম্পূর্ণ দায়িত্ত্ব নিতে প্রস্তুত। পশুর হাটের ভিড়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি, কুরবানি আর মাংস প্রস্তুত এবং গরিবদের মধ্যে বিতরণের পুরো দায়িত্বটাই হালাল বাজারের কর্মীরা আপনার হয়ে পালন করবেন। আপনাকে হাটে যেতে হবে না, কশাই খুঁজতে হবে না, মাংস প্রস্তুতের ঝামেলা থেকেও মুক্ত থাকবেন। হালাল বাজার তার কর্মীদের যত্নসহকারে হালাল ভাবে কুরবানি প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে প্রশিক্ষন দিয়েছে। তারা স্বাস্থ্যকর গরু এবং ছাগল সরবরাহ করবে এবং এটাও নিশ্চিত করবে যে কুরবানির জবাইয়ের কাজটি যেন ধারালো অস্ত্র দিয়ে ইসলামী উপায়ে দেওয়া হয়। আপনার প্রদত্ত নামে কুরবানী করার ছবি এবং ভিডিও সহ প্ৰমাণ আপনাকে প্রদান করা হবে। ঈদ উল আজহার দিনে.আপনার কুরবানি থেকে সমস্ত গোশত সামাজিক দূরত্ব নির্দেশিকা অনুসরন করে বাংলাদেশের দরিদ্র, অভাবী এবং অনাথ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে করোনাকালীন এ সময়ে যথাযথভাবে কুরবানি করে তার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের তাওফিক দান করুন। করোনাকালীন সময়ে যথাযথ নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সচেতনার প্রতি লক্ষ্য রাখার তাওফিক দান করুন। করোনার অজুহাত দিয়ে কুরবানি না করে দান খয়রাত করে কুরবানি হক আদায় হয়ে গেছে মনে করা থেকেও বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। বরংচ কুরবানী পালনের সাথে সাথে অতিরিক্ত দান করে গরিবদের সহায়তা করার তৌফিক দান করুক! আমিন। 

Translate »
X