x

মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক

অনবন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা ইত্যাদি একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। আর এ অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে মানুষ প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ সামাজিক জীব। পৃথিবীর কোন মানুষই একা তার সকল কাজ করতে পারে না। শিল্পায়নের এ যুগে জীবনধারণের জন্য প্রত্যেক মানুষকেই একে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এক ব্যক্তির অধীনে একাধিক ব্যক্তি কাজকর্ম করে। এতে কেউ মালিক হয় আবার কেউ হয় শ্রমিক। মালিকের সাথে শ্রমিকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। মালিক শ্রেণি যেমন শ্রমিক ছাড়া চলতে পারে না, তেমনিভাবে শ্রমিক শ্রেণির দৈনন্দিন জীবন মালিক শ্রেণির বেতন-ভাতার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের কাজ শ্রমের মূল্য গ্রহন করা ঘৃনার কাজ নয়। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও শ্রমিকের কাজ করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো- কোন প্রকারের উপার্জন উত্তম ও পবিত্র? তিনি বললেন, কোনো ব্যক্তির নিজ শ্রমের উপার্জন এবং সৎব্যবসা লব্ধ মুনাফা। (বায়হাকী শরীফ)

ইসলাম অধীনস্থ লোকদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ.

অর্থ: “তোমরা পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্নীয়, ইয়াতিম ও মিসকীন, প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গীসাথী, মুসাফির ও  তোমাদের অধীনস্থ যেসব দাস-দাসী (শ্রমিক) রয়েছে তাদের প্রতিও সদয় হও।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত ৩৬) 

মলিক ও শ্রমিকের মাঝে এক চমৎকার দৃষ্টান্ত আমরা হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর জীবন থেকে পাই। তিনি বলেন, “আমি ১০ বছর যাবৎ রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খেদমত করেছি। তিনি আমার সম্পর্কে কখেনো উহ্‌! শব্দ বলেননি এবং কখনো বলেননি এটা করনি কেন? এটা করেছ কেন? আমার বহুকাজ তিনি নিজ হাতে করে দিতেন।” (বুখারী শরীফ)

হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমিরুল মুমিনিন ছিলেন। জেরুজালেম সফরে উটের পিঠে চড়া ও উট টেনে নেওয়ার ব্যাপারে তিনি সাম্য ও মানবতাবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি উটের পিঠে চড়া ও উটের রশি টানার বিষয়ে নিজের ও ভৃত্যের মাঝে পালাক্রম ঠিক করে নিয়েছিলেন। মালিক-শ্রমিকের এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।

বিদায় হজ্বের সময় রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, একজন অধীনস্থ কর্মচারীকে কতবার ক্ষমা করা যেতে পারে? রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন- 

كُلَّ يَوْمٍ سَبْعِيْنَ.

অর্থ: দৈনিক ৭০ বার। (তিরমিযি শরীফ)

মনিবের উচিত তার শ্রমিকের শক্তি ও সামর্থ্য বিচার করে তাকে কাজ দেওয়া। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

وَلَايُكَلِّفُ مِنَ الْعَمَلِ اِلَّا مَايُطِيْقُ.

অর্থ: “তাকে (শ্রমিককে) তার সাধ্য ও সামর্থ্যের বাইরে কোন কাজ দেওয়া যাবে না।” (মুসলিম শরীফ)

খাওয়া পরা থেকে আরম্ভ করে সকল কাজে মালিক শ্রমিকের মাঝে কোন বৈষম্য ইসলাম অনুমোদন করে না।

শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “তারা (যারা আমাদের কাজ করে) তোমাদের ভাই আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। সে (মালিক) যা খায় তার অধীনস্থদেরও যেন তা খাওয়ায়। সে (মালিক) যা পরে তাদেরকে যেন তা পরতে দেয়। আর তাকে এমন কর্মভার দেবে না যা তার ক্ষমতার বাইরে। এমন কাজ (ক্ষমতার বাইরে) হলে তাকে (শ্রমিককে) যেন সাহায্য করে।” (বুখারী ও মসলিম শরীফ)

খুব দ্রুত শ্রমিকের পারিশ্রমিক আদায়ের ব্যাপারে ইসলামের বিধান সুস্পষ্ট। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- 

اُعْطُوْا الْاَجِيْرَ اَجْرَهٗ قَبْلَ اَنْ يَّجِفَّ عَرَقُهٗ.

অর্থ: “শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।” (ইবনু মাজাহ শরীফ)

পারিশ্রমিক দিতে অকারণে বিলম্ব করা সমীচীন নয়। শ্রমিক যাতে তার শ্রমের সঠিক মূল্য পায় সে ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “মজুরের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিয়োগ কর না।” 

একইভাবে শ্রমিককেও তার মালিকের দেওয়া দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার ব্যাপারে ইসলামে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “গোলাম (শ্রমিক) যখন তার মালিকের কাজ সুচারুরূপে করে এবং সুষ্ঠুভাবে আল্লাহর ইবাদত করে তখন সে দ্বিগুণ প্রতিদান পায়।” (বুখারী ও মসলিম শরীফ)

মালিক-শ্রমিক যদি ইসলাম স্বীকৃত পন্থায় তাদের সম্পর্ক তৈরি করতে পারে, তাহলে শ্রমিক তার ন্যায্য পারিশ্রমিক পাবে আর মালিকও তার সঠিক শ্রম পাবে। শ্রমিক ও মালিকের মাঝে কোন দিন মনোমালিন্য হবে না। কলকারখানায় স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করবে। কাজেই দেশ ও জাতির কল্যাণে আমাদের ইসলাম প্রদত্ত আদর্শ শ্রমনীতি অনুসরণ করা উচিত।

Translate »
X